Daily Cricket
খবর

ইতিহাসের সাক্ষী: কার্ডিফে টাইগারদের প্রথম অস্ট্রেলিয়া বধ

- প্রকাশিত Thu, Jun 18, 2020 11:17 AM
ইতিহাসের সাক্ষী: কার্ডিফে টাইগারদের প্রথম অস্ট্রেলিয়া বধ
Thu, Jun 18, 2020 11:17 AM
ফটো: ডেইলি ক্রিকেট ডেস্ক

২০০৫ সালের জুনের কোনো একটা দিন। বিশ্ব ক্রিকেটের তৎকালীন পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়াকে বোকা বানিয়েছিল বাংলাদেশ। ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের ২য় ম্যাচে (অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ম্যাচ) বাংলাদেশ উইকেটের ব্যাবধানে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে পরাজিত করে একটা অঘটনের জন্ম দেয় হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন দলটি। আজ সেই জয়ের ১৫ তম বছর পূর্ণ হল। এটা এখন ইতিহাসের সাক্ষী। ইতিহাসের সাক্ষীর এই পর্বে থাকছে সেদিনের সেই জয়ের স্মৃতিচারন।

দিনটি ছিল ২০০৫ সালের আজকের এই দিন, অর্থাৎ ১৮ জুন। ইংল্যান্ডের কার্ডিফ শহরের সোফিয়া গ্রাউন্ডস শক্তশালী অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি ম্যাচের পর ম্যাচ হারতে থাকা বাংলাদেশ দল। ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচে ওভালে ইংল্যান্ডের কাছে শোচনীয় হারের পর কার্ডিফে এই ম্যাচেও কি বাংলাদেশকে হারতে হবে? অনেকেই হয়ত এটাই ভেবেছিল।

ভাবাটাই স্বাভাবিক। কেননা রিকি পন্টিং, ম্যাথু হেইডেন, অ্যাডাম গিলক্রিষ্ট, ডেমিয়েন মার্টিন, মাইক হাসি, মাইকেল ক্লার্কদের মত শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন-আপের সামনে কি মাশরাফি, রফিক, তাপস বৈশ্যরা টিকতে পারে? অপরদিকে গ্লেন ম্যাকগ্রাহ, জেসন গিলেস্পিদের মত শক্তিশালী পেস ব্যাটারির সামনে জাবেদ ওমর, নাফিস ইকবাল, তুশার, বাশারদের ব্যাটিং লাইট ফিউস হবারই কথা।

 

আরো পড়ুনঃ সঠিক সময়ে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে আশাবাদী নিউজিল্যান্ড

না, এমন কিছু সেদিন ঘটেনি। সেরকম কিছু ঘটতে দেবার আগেই অজিদের ব্যাটিং বৃক্ষের মূল শিকড়ে ছুরি বসিয়ে দিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা।

টসে জিতে ব্যাটিং নিলেন রিকি পন্টিং। নেবারই কথা। দলে যেখানে এত শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন-আপ রয়েছে সেখানে যে কোনো অধিনায়কই চাইবে বিশালাকার এক রানের পাহাড় দাড় করাতে। তারই নিমিত্তে টসে জিতে ব্যাটিং নিলেন পন্টিং, ব্যাট হাতে ২২ গজে নেমে পড়লেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ওপেনিং জুটি ম্যাথু হেইডেন-অ্যাডাম গিলক্রিষ্ট।

ইনিংসের ২য় বলেই লেগ-বিফোর হয়ে গিলক্রিষ্ট কে প্যাভিলিয়নে ফেরতে বাধ্য করালেন মাশরাফি। তখন যেন কার্ডিফ অস্ট্রেলিয়ার দর্শকদের জন্য হয় উঠল মরুর ন্যায় নিস্তব্ধ!

গিলক্রিষ্ট কে ফেরানোর পর মাশরাফির উল্লাস

 

ব্যাট হাতে আসলে অধিনায়ক রিকি পন্টিং। তিনিও টিকলেন না। ১৬ বল খেলে মাত্র রান করে তাপস বৈশ্যর বলে তিনিও এলবিডব্লিউ হলেন দলীয় রানের মাথায়। এত বড় শক্তিশালী দলে যে কেউ দাড়াতে পারবেনা, সেটা আসলে ভাবাটাও বোকামি। দাড়ালেন ডেমিয়েন মার্টিন। হেইডেন ক্লার্ককে সঙ্গে নিয়ে উইকেটে রান থেকে উইকেটে ১৬৫ পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। বাকি কাজটা অবশ্য করলেন মাইক হাসি   সাইমন ক্যাটিস।

৫০ ওভারের খেলা শেষে অস্ট্রেলিয়া দল ২৪৯/ রান দাড় করালো। মাইক হাসি ২১ বলে ৩১* সাইমন ক্যাটিস ২৩ বলে ৩৬* রান ছিল অস্ট্রেলিয়ার লজ্জা নিবারণের বস্ত্রের ন্যায়। এর আগে ডেমিয়েন মার্টিন ৭৭ মাইকেল ক্লার্কের ৫৪ রানটা ভিত গড়ে দিয়ে যায়।

বাংলাদেশের হয়ে মোহাম্মদ রফিক কিপ্টামি করলেন বল হাতে, কোনো উইকেট না পেলো ১০ ওভারের রান দিলেন মাত্র ৩১ রান। অপরদিকে মাশরাফির বোলিং ফিগার ১০-২-৩৩-১। তাপস বৈশ্য ৬৯ রান  দিয়ে নেন উইকেট।

তাপস বৈশ্যদের উল্লাস

 

২৫০ রানের লক্ষ্য। এটা তাড়া করে ম্যাচ জেতা চাট্টিখানি কথা না। তারপরেও ব্যাট হাতে নামলেন জাভেদ ওমর বেলিম নাফিস ইকবাল। উদ্ভোধনী জুটিতে আসলো ১৭ রান। রান করে আফিস ইকবাল আউট হলেও তুশার ইমরান এসে যেভাবে খেলতে শুরু করলেন তখন মনে হচ্ছিল দিনটা হয়ত তার। তবে ৩৫ বলে ২৪ রান করে ৫১ রানের মাথায় ফিরে গেলেন তুশার। বেলিমও ফিরলেন ক্ষণিক বাদেই।

২০. ওভারে ৭২ রান উইকেট পড়ে  গেলে কেউ হয়ত ভাবেনি সেখান থেকে নতুন করেও শুরু করা যায়। অধিনায়ক হাবিবুল বাশারকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। সে এক অতিমানবীয় ইনিংস।

৩০ তম ওভারে যখন বাংলাদেশের ১০০ রান পূর্ণ হল তখন যেই ওভার শেষে বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়াল ১২০ ওভারে ১৪৯ রান; ওভারপ্রতি পৌনে করে।

কিন্তু আশরাফুল বোধ সেদিন ব্যাপারটাকে মোটেও বড় করে দেখেন নি। হয়ত সেজন্যই ৩২তম ওভার থেকে খেলার মোমেন্টাম অন্যদিকে সরে যেতে শুরু করল। একে একে আশরাফুলের ব্যাট থেকে বেরিয়ে আসছিল চমৎকার সব শট। অবাক বিস্ময়ে সারা পৃথিবী দেখল বাংলাদেশের লিটল মাস্টার আশরাফুলের সেই বিখ্যাত স্কুপ প্যাডেল। ধারাভাষ্যকার আতাহার আলী খানের ভাষায় যেটাচিকি শট তরতর করে সামনে এগিয়ে যেতে থাকল বাংলাদেশের রানের চাকা। হাবিবুল বাশারের কথা না বললে বোধ এই মহাকাব্য অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। তিনি ঠান্ডা মাথায় গাইড করে যাচ্ছিলেন আশরাফুলকে আর চমৎকার ভাবে পালন করেছিলেন তাঁর সাপোর্টিং রোল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মিসফিল্ডিং থেকে অতিরিক্ত রান নিতে গিয়ে রান আউট হয়ে গেলেন তিনি। মাত্র তিন রানের জন্য মিস করলেন অর্ধশতক। দলীয় রান তখন ৪৪ ওভারে ২০২।

জয়ের জন্য দরকার ৪৮। প্রয়োজন ওভার প্রতি রানের। সেট ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ আশরাফুল হিসাব করেই এগুচ্ছিলেন। ৪৭ তম ওভারের শেষ বলে তুলে নিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম শতক। সম্ভবত পরিস্থিতির বিচারে এখন পর্যন্ত যেকোন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের খেলা সেরা ইনিংস ছিল সেটি। তবে সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে পরের বলেই আউট হয়ে ফিরে গেলেন তিনি।

আশরাফুলের সেই সেঞ্চুরি

 

চারদিকে তখন টানটান উত্তেজনা। বাংলাদেশ কি পারবে? এতক্ষণ যে স্বপ্ন হাবিবুল এবং আশরাফুল মিলে দেখিয়েছেন সেটা শুরুতে কেউ কল্পনাও করার সাহস পায়নি। কিন্তু স্বপ্নজয়ের এত কাছাকাছি এসে যদি স্বপ্নভঙ্গ হয়? মানুষ কি পারবে সেটা সহ্য করতে? ইংল্যান্ডে তখনও দিন তবে বাংলাদেশে সময় রাত সাড়ে ৯টার মত। রাস্তায় রাস্তায়, বাড়িতে বাড়িতে কোটি মানুষের চোখ তখন টিভির দিকে।

মোহাম্মদ রফিক এবং আফতাব মিলে পরের দুই ওভারে তুলে নিলেন ১৬ রান। শেষ ওভারের সমীকরণ দাঁড়াল তাই বলে রান। সবাই যখন ভাবছিল সিঙ্গেল নিয়ে নিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছাবার কথা সেই সময়ে টিনএজার আফতাব হয়ত ভাবছিলেন অন্যকিছু। ওভারের প্রথম বলটিকেই বোলার গিলেস্পির মাথার উপর দিয়ে সোজা পাঠিয়ে দিলেন মাঠের বাইরে! এর সাথেই বাইরে পাঠিয়ে দিলেন অজিদের মান বাঁচানোর শেষ আশাটুকুও। পরের বলেই এল সেই বহুল কাঙ্খিত সিঙ্গেলটি। বাংলাদেশ পৌঁছে গেল স্বপ্নজয়ের বন্দরে। আজও আফতাবের সেই ছক্কাটা আপ্লুত করে কোটি কোটি ক্রিকেট পাগল বাংলাদেশীকে। খুব বেশি লম্বা ক্যারিয়ারের মালিক না হলেও বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা আজও এই হার্ড হিটারকে মনে রেখেছেন ছক্কার জন্য।

ম্যাচ জয়ের পর আফতাবের সেই দৌড়

 

অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার জন্য রাতটা ছিল ভয়ানক রকমের আতংকের এবং হতাশার। রিকি পন্টিং এই হারকে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে হার বলেছিলেন। তবে অজি অধিনায়কের এই দম্ভোক্তি আসলে বেশিদিন আর স্থায়ী হয়নি। সেবার আসন্ন অ্যাশেজেই সমাপ্তি ঘটে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের অপরাজেয় যুগের। বিশ বছর পর  - হেরে তাদের অ্যাশেজে হাত ছাড়া হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় এই সংবাদটা ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম বড় আপসেট হিসাবে প্রচার করা হলেও ততক্ষণে সারা পৃথিবী শুনতে পেয়েছে বাঘের গর্জন। বিশ্ববাসী বুঝতে পেরেছিল আচিরেই এক নতুন শক্তির আগমন ঘটতে চলেছে ক্রিকেট বিশ্বে!

সেই মহাকাব্যিক ম্যাচটির পর কেটে গেছে ১৫ বছর। এখন ক্রিকেটের মাঠে বাংলাদেশ আর সেই আগের বাংলাদেশ নেই। আমরা লড়তে শিখেছি, জিততে শিখেছি। একের পর এক ওডিআই সিরিজ জিতেই চলেছি। কিন্তু কোটি কোটি ক্রিকেট প্রেমীর মনে কার্ডিফ কীর্তির আবেদন এত টুকুও কমেনি। তাই তো সুযোগ পেলে আজও আমাদের বারবার পড়তে ইচ্ছে করে অস্ট্রেলিয়া বধের সেই অজর কাব্য।

এন্ড্রোয়েড ব্যবহারকারিরা গুগল প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করুন ডেইলিক্রিকেট অ্যাপএন্ড্রোয়েড ডেইলিক্রিকেট অ্যাপ 

আইওএস ব্যবহারকারিরা ডাউনলোড করুন ডেইলিক্রিকেট অ্যাপ:আইওএস ডেইলিক্রিকেট অ্যাপ

মন্তব্য

সর্বশেষ ভিডিও